আজ থেকে বন্ধ অতিরিক্ত সিম – ইউএনবি।

 

ডিএনবি নিউজ ডেস্ক:

বহুল আলোচিত এবং প্রতীক্ষিত বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) নতুন নির্দেশনাটি আজ, শনিবার থেকে কার্যকর হয়েছে। এই নির্দেশনার ফলে এখন থেকে একজন নাগরিক তাঁর জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) বিপরীতে সর্বোচ্চ ১০টি সিম ব্যবহার করতে পারবেন। অতিরিক্ত সক্রিয় সিমগুলো আজ থেকেই দেশের মোবাইল ফোন অপারেটরগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ করে দেওয়া শুরু করেছে। এই পদক্ষেপটি সিম ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ফেরানো এবং মোবাইলভিত্তিক প্রতারণা রোধ করার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

সিম ব্যবহারের সীমা ১৫ থেকে ১০-এ নামল

দীর্ঘদিন ধরে একজন গ্রাহক তার জাতীয় পরিচয়পত্রের বিপরীতে সর্বোচ্চ ১৫টি সিমকার্ড ব্যবহার করার সুযোগ পেতেন। কিন্তু গত ৩০ জুলাই, ২০২৫ তারিখে বিটিআরসি একটি গুরুত্বপূর্ণ নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সংস্থাটি ঘোষণা করে যে, এই সংখ্যা কমিয়ে ১০টিতে আনা হবে এবং নভেম্বর মাস থেকে অতিরিক্ত সিম নিষ্ক্রিয় করার কাজ শুরু হবে। সেই ঘোষণা অনুযায়ী, আজ ১ নভেম্বর, ২০২৫ থেকে এই নিয়ম পুরোপুরি কার্যকর হলো।

বিটিআরসি সম্প্রতি জারি করা এক বিজ্ঞপ্তিতে স্পষ্ট করে জানিয়েছে যে, নভেম্বর মাস থেকে এই অতিরিক্ত সিমগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিষ্ক্রিয় হয়ে যাবে। এটি একটি কঠোর পদক্ষেপ, যা গ্রাহকদের তাদের সক্রিয় সিমের সংখ্যা যাচাই করতে এবং অপ্রয়োজনীয় সিমগুলো বন্ধ করতে উৎসাহিত করছে।

গুরুত্বপূর্ণ সিম বন্ধ হওয়ার ঝুঁকি ও করণীয়

এই স্বয়ংক্রিয় নিষ্ক্রিয়করণ প্রক্রিয়ার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, যেসব ব্যবহারকারী নিজেরা অতিরিক্ত সিম বন্ধ করার উদ্যোগ নেবেন না, তাদের এনআইডিতে নিবন্ধিত গুরুত্বপূর্ণ সিমকার্ডও বন্ধ হয়ে যেতে পারে। কারণ, সিম বন্ধ করার ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ ‘দৈবচয়ন’ (র‌্যান্ডম সিলেকশন) নীতি অনুসরণ করবে। অর্থাৎ, গ্রাহকের পছন্দ বা প্রয়োজনের তোয়াক্কা না করে যেকোনো অতিরিক্ত সিম বন্ধ করে দেওয়া হতে পারে। এটি গ্রাহকদের জন্য একটি জরুরি সতর্কবার্তা।

অতিরিক্ত সিম ডি-রেজিস্ট্রেশন বা বন্ধ করতে হলে গ্রাহকদের দ্রুত সংশ্লিষ্ট অপারেটরের কাস্টমার কেয়ার সেন্টারে যোগাযোগ করতে হবে। কাস্টমার কেয়ারে গিয়ে গ্রাহক তাঁর এনআইডির বিপরীতে নিবন্ধিত সিমগুলোর তালিকা দেখতে পারবেন এবং কোনটি রাখতে চান আর কোনটি বন্ধ করতে চান, সেই সিদ্ধান্ত জানাতে পারবেন। এই প্রক্রিয়াটি গ্রাহককে তার প্রয়োজনীয় সিমগুলো সক্রিয় রাখার নিশ্চয়তা দেবে।

বিটিআরসি’র দৃঢ়তা: ডিসেম্বরের মধ্যে লক্ষ্য অর্জন

বিটিআরসি চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) এমদাদ উল বারী গণমাধ্যমকে দেওয়া এক বক্তব্যে এই পদক্ষেপের বিষয়ে কমিশনের দৃঢ় অবস্থান ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন, “আজ শনিবার (১ নভেম্বর) থেকেই অপারেটররা অতিরিক্ত সিম নিষ্ক্রিয় করা শুরু করেছে। আমরা দৃঢ়ভাবে আশাবাদী যে, ডিসেম্বর মাসের মধ্যে আমরা নিশ্চিত করব, কোনো এনআইডির নামে ১০টির বেশি সিম সক্রিয় থাকবে না।

বিটিআরসি চেয়ারম্যানের এই মন্তব্য সরকারের এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের জিরো টলারেন্স নীতিকেই তুলে ধরে। এই স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা বাস্তবায়নে অপারেটরদের সফটওয়্যারে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনা হয়েছে এবং বিটিআরসি মনিটরিং-এর মাধ্যমে এই প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করবে।

পরিসংখ্যান: কেন এই কঠোর সিদ্ধান্ত?

বিটিআরসি’র পরিসংখ্যানে মোবাইল সিমের সংখ্যার একটি স্পষ্ট অসঙ্গতি দেখা যায়, যা এই সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা প্রমাণ করে। ২০২৫ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত দেশে সক্রিয় মোবাইল সিমের সংখ্যা ছিল প্রায় ১৮ কোটি ৬২ লাখ। অথচ এই সময়ে দেশের প্রকৃত মোবাইল গ্রাহক সংখ্যা ছিল প্রায় ছয় কোটি ৭৫ লাখ। এই বিশাল ব্যবধানই প্রমাণ করে যে, একজন গ্রাহকের নামে একাধিক সিম নিবন্ধিত হচ্ছে, যা ব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে।

পরিসংখ্যান আরও দেখায় যে:

  • ৮০ শতাংশের বেশি ব্যবহারকারীর নামে পাঁচটির কম সিম সক্রিয় রয়েছে।
  • ৬ থেকে ১০টি সিম ব্যবহার করছেন প্রায় ১৬ শতাংশ গ্রাহক।
  • ১১টির বেশি সিম ব্যবহার করছেন মাত্র তিন শতাংশ গ্রাহক, যারা মূলত এই নতুন নিয়মের আওতায় আসছেন।

যদিও এই ব্যবহারকারীর সংখ্যা শতাংশের হিসাবে কম, তবুও এদের কারণেই সিমের অতিরিক্ত নিবন্ধন এবং তা থেকে সৃষ্ট জটিলতা তৈরি হচ্ছিল। এই অতিরিক্ত সিমগুলো অনেক সময়ই অব্যবহৃত বা প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি করত।

শৃঙ্খলা ফেরানো ও প্রতারণা রোধই মূল লক্ষ্য

বিটিআরসি কর্মকর্তারা এই সিদ্ধান্তের মূল কারণ ব্যাখ্যা করে জানিয়েছেন যে, সিম ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ফেরানো এবং মোবাইলভিত্তিক প্রতারণা রোধ করাই এই নতুন নিয়মের প্রধান উদ্দেশ্য। অতিরিক্ত সিমকার্ডের ব্যবহার প্রায়শই অবৈধ ভিওআইপি (VoIP) কার্যক্রমে এবং বিভিন্ন আর্থিক প্রতারণা যেমন—ফিশিং বা চাঁদাবাজিতে ব্যবহৃত হয়। সিমের সংখ্যা সীমিত করার মাধ্যমে এই ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের বিস্তার অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে বলে কমিশন মনে করে।

এছাড়াও, একটি এনআইডির বিপরীতে মাত্রাতিরিক্ত সিম থাকার কারণে সিমের প্রকৃত ব্যবহারকারী চিহ্নিত করা কঠিন হয়, যা নিরাপত্তা সংস্থাগুলোর তদন্ত কাজকেও ব্যাহত করে। ১০টি সিমের সীমা নির্ধারণ করার ফলে প্রত্যেক গ্রাহকের দায়বদ্ধতা বাড়বে এবং সিমের অপব্যবহার রোধ করা যাবে।

আপনার এনআইডিতে কয়টি সিম? যাচাই করার উপায়

গ্রাহকদের মধ্যে যেন কোনো বিভ্রান্তি না থাকে, সেজন্য বিটিআরসি সহজ উপায়ে তাদের নিবন্ধিত সিমের সংখ্যা যাচাই করার সুযোগ দিয়েছে। গ্রাহকরা খুব সহজেই *অনলাইনে বা ১৬০০২# ডায়াল করে নিজেদের এনআইডিতে নিবন্ধিত সিমের সংখ্যা যাচাই করতে পারেন। এই যাচাই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে গ্রাহকরা জানতে পারবেন তাদের কোন কোন অপারেটরের কতগুলো সিম সক্রিয় আছে এবং সেই অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারবেন।

গ্রাহকদের প্রতি নির্দেশনা হলো, যত দ্রুত সম্ভব তারা যেন এই যাচাই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন এবং অতিরিক্ত সিম থাকলে তা কাস্টমার কেয়ারে গিয়ে ডি-রেজিস্ট্রেশন করে নেন। এতে করে তাদের গুরুত্বপূর্ণ সিমগুলো দৈবচয়নের মাধ্যমে বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি এড়ানো যাবে।

ডিজিটাল বাংলাদেশের পথে আরও একধাপ

বিটিআরসি’র এই উদ্যোগ কেবল সিম ব্যবস্থাপনার একটি প্রশাসনিক পরিবর্তন নয়, বরং এটি ডিজিটাল বাংলাদেশের পথে সুশৃঙ্খল এবং নিরাপদ যোগাযোগ নিশ্চিত করার একটি বড় পদক্ষেপ। সিমের সুব্যবস্থাপনা দেশের টেলিযোগাযোগ খাতে স্বচ্ছতা আনবে এবং গ্রাহকদের আস্থাও বাড়াবে। এই পদক্ষেপের সফল বাস্তবায়ন দেশের সাইবার নিরাপত্তা জোরদার করতে এবং মোবাইল আর্থিক সেবার (MFS) অপব্যবহার কমাতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।

অপারেটর এবং গ্রাহক—উভয় পক্ষই এই নতুন নিয়মের সঙ্গে দ্রুত মানিয়ে নিতে পারলে ডিসেম্বরের মধ্যে সিম ব্যবস্থাপনা নিয়ে সরকারের লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব হবে, যা দেশের সামগ্রিক ডিজিটাল ইকোসিস্টেমের জন্য ইতিবাচক বার্তা দেবে।

Print

সম্পর্কিত পোস্ট

''আপনার মতামত দিন''

ডিএনবি নিউজ ২৪.কম