ই’তিকাফে বসে যা করা যাবে, যা করা যাবে না
সারিব সুইজা,
ইবাদতের মাস রমজান মাস। আল্লাহর রহমত,মাগফেরাত,নাজাতবেষ্টিত এই মাস। বেশি বেশি আমল করে নিজের নেকির থলে সমৃদ্ধ করার মাস এটি। এই মাসের প্রধান আমল হচ্ছে রোযা আদায় করা। এর পাশাপাশি আরো কিছু আমল রয়েছে। তন্মধ্যে ইতেকাফ অন্যতম। আজ থেকে দেশের মসজিদে ও বাসাবাড়িতে ধর্মপ্রাণ মানুষ বসবে ই’তিকাফে। কিন্তু এ ই’তিকাফে বসে কী করা যাবে? কী করা যাবে না? তা আমাদের অনেকেরই জানা নেই। তাই আসুন জেনে নেয়া যাক তখন কী করা যাবে, কী করা যাবে না-
যেসব কারণে ই’তেকাফ ভেঙে যায়-
যেসব কাজ করলে ই’তেকাফকারীর ইতেকাফ ভেঙে যায় তা হলো;
১.যেসব জরুরতের কারণে মসজিদ থেকে বের হওয়া যায় সেসব ক্ষেত্রে বের হয়ে বাইরে সেই জরুরত ছাড়া একটু বেশি সময় অবস্থান করলে।
২.শরয়ী জরুরত ছাড়া মসজিদ থেকে বের হলেই ইতেকাফ ভেঙে যাবে।চাই তা ইচ্ছে করে হোক অথবা ভুলে হোক।
৩.ই’তেকাফকারী ব্যক্তি মসজিদের সীমানা মনে করে বের হয়েছে,পড়ে জানতে পারলো এটা মসজিদের সীমানার বাইরে ছিলো তাহলে সেক্ষেত্রেও ইতেকাফ ভেঙে যাবে।
৪.ই’তেকাফের জন্য রোযা শর্ত।তাই কেউ যদি রোযা ভেঙে ফেলে তাহলে তার ইতেকাফও ভেঙে যাবে।
৫.স্ত্রীর সাথে সহবাস করার দ্বারা ইতেকাফ ভেঙে যাবে,চাই সহবাস ইচ্ছে করে হোক বা অনিচ্ছাকৃত। ৬.স্ত্রীকে চুমু বা স্পর্শ করলে যদি ‘মনি’ বের হয়,তাহলে সেক্ষেত্রেও ইতেকাফ ভেঙে যাবে।
৭.ওযুর কারণ ছাড়া শুধু এমনিতেই ব্রাশ, মেসওয়াক করতে বের হলে।
৮. বিড়ি খাওয়ার জন্য বের হলে।
৯.খাবার খাওয়ার পর হাত পরিষ্কার করার জন্য বের হলে ইতেকাফ ভেঙে যাবে।
যেসব কারণে ই’তেকাফকারী মসজিদ থেকে বের হতে পারবেন-
বর্তমানে অনেক মানুষ ই’তেকাফ করে যে কোনো ঠুনকো অজুহাতে মসজিদ থেকে বের হয়। অযথা মসজিদের বাহিরে সময় নষ্ট করে। অথচ ই’তেকাফকারীর জন্য যে কোনোও কারণেই মসজিদ থেকে বের হওয়ার অনুমতি নেই। বরং তার বের হওয়ার নির্দিষ্ট কিছু কারণ আছে। নিম্মে এ বিষয়ে আলোচনা করা হলো।
ই’তেকাফকারী ব্যক্তি ‘শরয়ী জরুরত’,’মানবীয় জরুরত’ বা একান্তই জরুরি কাজ ছাড়া মসজিদ থেকে বের হতে পারবেন না।যেমন;
১. মলত্যাগ করার জন্য। ২.ফরয গোসল করার জন্য, যদি মসজিদে সম্ভব না হয়।কিন্তু ফরয গোসল ছাড়া অন্য যেকোনো গোসলের জন্য মসজিদ থেকে বের হলে ইতেকাফ ভেঙে যাবে। হ্যাঁ এটা করা যেতে পারে যে, ঠাণ্ডার জন্য, জুমার দিন জুমার জন্য গোসল করতে চাইলে মসজিদের সীমানার ভেতরে থেকে শরীরে তাড়াতাড়ি হালকা পানি দিয়ে নিতে পারবে তবে খেয়াল রাখতে হবে, যেনো মসজিদের ভেতর পানি না যায়।৩.ওযু করার জন্য, যদি মসজিদের সীমানার ভেতর থেকে সম্ভব না হয়।৪.খাবার আনার জন্য বাড়িতে যাওয়া, যদি খাবার এনে দেওয়ার কেউ না থাকে।৫.মোয়াজ্জেন আজান দেওয়ার জন্য। ৬.যেই মসজিদে ইতেকাফ অবস্থায় আছে সেই মসজিদ জুমার মসজিদ না হলে জুমা আদায় করার জন্য। ৭.মসজিদের ক্ষয়ক্ষতি হলে,জালেম মসজিদ থেকে বের করে দিলে তিনি সেই মসজিদ থেকে বের হয়ে অন্য মসজিদে গিয়ে ইতেকাফ করতে পারবেন।
এখানে আরেকটি বিষয় জনসাধারণের জন্য জেনে নেওয়া জরুরি যে, জানাযা এবং অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যাওয়া।
আল্লামা তাকী উসমানি হাফিজাহুল্লাহ বলেন,এক্ষেত্রে হুকুম হলো সর্বাবস্থায় অর্থাৎ শুধু জানাযার জন্য বা অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখতে যাওয়ার জন্য মসজিদ থেকে বের হওয়া জায়েয নেই।কিন্তু কেউ যদি মলত্যাগ করার উদ্দেশ্যে বের হয়ে রাস্তার পাশেই চলা অবস্থায় কোন জানাযা বা অসুস্থ ব্যক্তির খোঁজ নেয় তাহলে কোন সমস্যা নেই। তবে শর্ত হলো বের হওয়ার সময় মলত্যাগ করার উদ্দেশ্যে বের হতে হবে।জানাযা বা অসুস্থ ব্যক্তিকে দেখার উদ্দেশ্যে বের হলে ইতেকাফ ভেঙে যাবে।আরেকটি শর্ত হলো রাস্তা থেকে দূরে যাওয়া যাবে না এবং রাস্তার ভেতর দাঁড়ানো যাবে না।
এগুলো ছাড়া আর কোন কারণে মসজিদ থেকে বের হওয়া যাবে না। বের হলে ই’তেকাফ ভেঙ্গে যাবে।
ই’তেকাফ ভেঙে গেলে করণীয়-
১.কোন ব্যক্তির যদি সুন্নাত ইতেকাফ ভেঙে যায় তাহলে সেই ব্যক্তি শুধু ওই দিনের ইতেকাফ কাযা করবে।পুরো দশ দিনের কাযা করতে হবে না। তবে যেদিন কাযা করবে সেদিন রোযাও রাখতে হবে।
২.কোন কারণে ভেঙে গেলে উচিৎ মসজিদই অবস্থান করা।সুন্নাত ইতেকাফ না হলেও নফল ই’তেকাফের ফজিলত পাওয়া যাবে।
ইতেকাফ ভাঙা জায়েজ যে কারণে-
১.ইতেকাফকারী যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে, যার চিকিৎসা মসজিদের বাইরে যাওয়া ছাড়া সম্ভব নয় তবে তার জন্য ইতেকাফ ভেঙে দেওয়ার অনুমতি আছে। (শামী)
২.বাইরে কোনো লোক ডুবে যাচ্ছে বা আগুনে দগ্ধ হচ্ছে তাকে বাঁচানোর আর কেউ নেই, অনুরূপ কোথাও আগুন লেগেছে, নেভানোর কেউ নেই তবে অন্যের প্রাণ বাঁচানোর এবং আগুন নেভানোর জন্য ইতেকাফকারীর ইতেকাফ ভেঙে দেওয়ার অনুমতি আছে।
৩ জোরপূর্বক মসজিদ থেকে ইতেকাফকারীকে বের করে নিয়ে যাওয়া হয় যেমন ওয়ারেন্ট এসে গেলে ইতেকাফ ভেঙে দেওয়া জায়েজ। সেরূপ ইতেকাফকারীর যদি এমন সাক্ষ্য দেওয়া জরুরি হয়ে পড়ে, যা শরিয়তানুযায়ী তার জন্য ওয়াজিব সেরূপ সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য ইতেকাফ ছেড়ে যাওয়ার অনুমতি আছে।
৪.মা-বাবা, স্ত্রী, সন্তান-সন্ততির কঠিন অসুস্থতার কারণেও ইতেকাফ ভেঙে দেওয়া জায়েজ। তেমনি পরিবারের কারো প্রাণ, সম্পদ বা ইজ্জত আশঙ্কার সম্মুখীন হলে এবং ইতেকাফ অবস্থায় তা প্রতিরোধের ব্যবস্থা করা সম্ভব না হলে ইতেকাফ ভেঙে দেওয়া জায়েজ।
৫.এ ছাড়া যদি কোনো জানাজা হাজির হয় এবং জানাজা পড়ানোর কেউ না থাকে তখনো ইতেকাফ ভেঙে দেওয়া জায়েজ। (ফতহুল কবীর) উল্লিখিত প্রয়োজন পূরণ করতে বের হলেই ইতেকাফ ভেঙে যাবে, তবে গোনাহ হবে না। (বাহরুর রায়েক)
ইতেকাফ অবস্থায় যেসব কাজ মাকরূহ-
ইতেকাফ অবস্থায় চুপ থাকলে সওয়াব হয় এই মনে করে চুপ থাকা মাকরূহে তাহরীমী।
বিনা প্রয়োজনে পার্থিব কোনো কাজে লিপ্ত হওয়া যেমন ;বেচাকেনা করা মাকরূহ। তবে একান্ত প্রয়োজনে মসজিদে মালামাল উপস্থিত করা ব্যতিত বেচাকেনার চুক্তি করা যাবে।
ইতেকাফ অবস্থায় করণীয়-
ইতেকাফ অবস্থায় ভালো এবং নেক কথা বলা। অতিরিক্ত কথাবার্তা না বলা। বেকার বসে না থেকে নফল নামাজ পড়া কোরআন তেলাওয়াত করা। তাসবিহ-তাহলীলে মশগুল থাকা। বেশি বেশি দোয়া করা।আল্লাহর দরবারে রোনাজারি করা।শবে কদরের রাত্র খোঁজ করা।তবে ইতেকাফ অবস্থায় বিশেষ কোনো ইবাদত নেই। তাই যেকোনো ইবাদত মন চাইলে করা যাবে।
সুতরাং আমাদের ভালো করে ই’তেকাফের বিষয় গুলো বুঝতে হবে।সমাজে অহরহ দেখা যাচ্ছে মানুষ ই’তেকাফে বসছে কিন্তু মাসয়ালা না জানার কারণে তার সুন্নাত ইতেকাফ আদায় হচ্ছে না।ই’তেকাফ যেমন অনেক ফজিলতের তেমনিভাবে বিষয়টি অনেক সুক্ষ্ম। তাই সোচ্চার হয়ে কাজ করতে হবে।তখনই না আমরা ই’তেকাফের ফজিলত পাবো।
মহিলাদের ই’তেকাফ-
ই’তেকাফের ফজিলত শুধু পুরুষদের জন্য নির্ধারিত নয়,মহিলাদের জন্যও রয়েছে এর ফজিলত।
১.তবে মহিলারা মসজিদে ইতেকাফ করতে পারবে না।তারা ঘরের একটি জায়গাকে ইবাদতের জন্য নির্দিষ্ট করে সেখানে অবস্থান করবে।
২.বিবাহিত মহিলা হলে স্বামীর অনুমতি নিয়ে ই’তেকাফে বসতে হবে।
৩.স্বামীর অনুমতি নিয়ে ই’তেকাফে বসার পর যদি স্বামী আবার নিষেধ করে তাহলে স্বামীর কথা মানা জরুরি নয়।
৪.মাসিক দিনগুলো থেকে পবিত্র হয়ে ই’তেকাফে বসতে হবে।অর্থাৎ মহিলা খেয়াল করবে যে, ই’তেকাফের দিনগুলোতে তার মাসিক হওয়ার সম্ভাবনা আছে কিনা।
৫.কোনো মহিলা ইতেকাফ শুরু করে দেওয়ার পর মাসিক শুরু হলে ওইদিনের ই’তেকাফ ভেঙে যাবে এবং সেইদিনের ইতেকাফ কাযা করতে হবে।
৬.মহিলা ঘরের যেই জায়গায় ই’তেকাফে বসবে সেই জায়গা তার জন্য মসজিদের হুকুমে হবে।সুতরাং কোনো শরয়ী বা একান্ত মানবীয় জরুরত ছাড়া সেখান থেকে বের হলে তার ই’তেকাফ ভেঙে যাবে।
৭.পুরুষদের জন্য যেসব কারণে মসজিদ থেকে বের হওয়া জায়েয আছে তেমনিভাবে সেই সকল কারণে মহিলাদের জন্যও ঘরের সেই নির্দিষ্ট জায়গা থেকে বের হওয়া জায়েয আছে। যেসব কাজ করলে পুরুষের ই’তেকাফ ভেঙে যায়, একজন ই’তেকাফকারী মহিলা সেই কাজ করলেও তার ইতেকাফ ভেঙে যাবে।
আমাদের সমাজে মহিলাদের এই ফজিলতের কাজটি করতে কম দেখা যায়।এক্ষেত্রে তাদের অবহেলা দেখা যায়।যাদের বিশেষ কোনো জরুরি নেই তাদের জন্য ই’তেকাফে বসে ইবাদতে কাটিয়ে দিয়ে উল্লিখিত ফজিলত গুলো পাওয়াই কাম্য।
জ্ঞাতব্য – অনেক এলাকায় দেখা যায় কেউ মসজিদে ইতেকাফে বসে না বিধায় এলাকার কোন এক ব্যক্তিকে সকলে টাকা দিয়ে মসজিদে বসায়।যা কোনভাবেই জায়েয নয়।এভাবে ই’তেকাফে বসালে ই’তেকাফ আদায় হবে না উলটো গুনাহগার হবে।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে পবিত্র মাহে রমজানে মসজিদে ইতিকাফ করার মাধ্যমে গুনাহের পাপরাশি থেকে বেঁচে থেকে অশেষ নেকি লাভের মোক্ষম সুযোগ দান করুন।